পদ প্রকরণ pdf: পদ প্রকরণ বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে বাক্যের শব্দগুলোকে অর্থ ও ব্যবহার অনুযায়ী ভাগ করা হয়। বাংলা ভাষায় পদ পাঁচ প্রকার—বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া ও অব্যয়। বিশেষ্য পদ কোনো নাম বোঝায়; বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামের গুণ বোঝায়; সর্বনাম পদ নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়; ক্রিয়া পদ কোনো কাজ বা অবস্থা প্রকাশ করে; আর অব্যয় পদ বাক্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, কিন্তু তাদের রূপ পরিবর্তন হয় না। আরো বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো। তাহলে চলো, শুরু করি।
বাংলা ভাষার পদ প্রকরণ PDF
১। বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দই এক একটি পদ।
২। পদ প্রধানত দুই প্রকার। যেমন: সব্যয় পদ ও অব্যয় পদ।
৩। সব্যয় পদ চার প্রকার। যেমন: ১. বিশেষ্য ২. সর্বনাম ৩. বিশেষণ ৪. ক্রিয়া
৪। পদ মোট পাঁচ প্রকার। যেমন: ১. বিশেষ্য ২. সর্বনাম ৩. বিশেষণ ৪. ক্রিয়া ৫. অব্যয়।
৫। বিশেষ্য পদ: কোনো কিছুর নামকে বিশেষ্য পদ বলে। বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত যে সমস্ত পদ দ্বারা কোনো ব্যক্তি, জাতি, সমষ্টি, বস্তু, স্থান, কাল, বার, কর্ম বা গুণের নাম বোঝানো হয় তাদের বিশেষ্য পদ বলে।
৬। বিশেষ্য পদ ছয় প্রকার। যেমন:
১. নামবাচক বা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য / Proper Noun
২. জাতিবাচক বিশেষ্য / Common Noun
৩. বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য / Material Noun
৪. সমষ্টিবাচক বিশেষ্য / Collecti Noun
৫. ভাববাচক বিশেষ্য / Verbal Noun
৬. গুণবাচক বিশেষ্য / Abstract Noun
৭। নামবাচক বিশেষ্য: যে পদ দ্বারা কোনো ব্যক্তি, ভৌগোলিক স্থান, গ্রন্থ ইত্যাদির নাম বা সংজ্ঞা প্রকাশ পায় তাকে নামবাচক বা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন:
ক) ব্যক্তির নাম: নজরুল, ওমর, আনিস, মাইকেল
খ) ভৌগোলিক স্থানের ঢাকা, দিল্লি, লন্ডন, মক্কা
গ) ভৌগোলিক সংজ্ঞা: (নদী, পর্বত, সমুদ্র ইত্যাদি)-মেঘনা, হিমালয়, আরব সাগর
ঘ) গ্রন্থের নাম: গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা, দেশে-বিদেশে, বিশ্বনবি
৮। জাতিবাচক বিশেষ্যঃ যে পদ দ্বারা কোনো একজাতীয় প্রাণী বা পদার্থের সাধারণ নাম বোঝায় তাকে জাতিবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন: মানুষ, গরু, পাখি, গাছ, পর্বত, নদী, ইংরেজ।
৯। বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য: যে পদে কোনো উপাদানবাচক পদার্থের নাম বোঝায় তাকে বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য বলে। এই জাতীয় বস্তুর সংখ্যা ও পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। যেমন: বই, খাতা, কলম, থালা, বাটি, মাটি, চাল, চিনি, লবণ, পানি।
১০। সমষ্টিবাচক বিশেষ্য: যে পদে বেশকিছু সংখ্যক ব্যক্তি বা প্রাণীর সমষ্টি বোঝায় তাই সমষ্টিবাচক বিশেষ্য। যেমন সভা, জনতা, সমিতি, পঞ্চায়েত, মাহফিল, ঝাঁক, বহর, দল।
১১। ভাববাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য পদে কোনো ক্রিয়ার ভাব বা কাজের ভাব প্রকাশিত হয় তাকে ভাববাচক বিশেষ্য বলে। যেমন: গমন (যাওয়ার ভাব বা কাজ), দর্শন (দেখার কাজ), ভোজন (খাওয়ার কাজ), শয়ন (শোয়ার কাজ), দেখা, শোনা।
১২। গুণবাচক বিশেষ্য: যে বিশেষ্য দ্বারা কোনো বস্তুর দোষ বা গুণের নাম বোঝায় তাই গুণবাচক বিশেষ্য। যেমন: মধুর মিষ্টত্বের গুণ-মধুরতা তরল দ্রব্যের গুণ-তারল্য তিক্ত দ্রব্যের দোষ বা গুণ-তিক্ততা তরুণের গুণ-তারুণ্য এরূপ: সৌরভ, স্বাস্থ্য, যৌবন, সুখ, দুঃখ।
১৩। সর্বনাম পদ: বিশেষ্যের পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয় তাকে সর্বনাম পদ বলে। সর্বনাম সাধারণত ইতোপূর্বে ব্যবহৃত বিশেষ্যের প্রতিনিধি স্থানীয় শব্দ।
১৪। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সর্বনামকে ১০ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
১. ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক: আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, সে, তারা, তাহারা, তিনি, তাঁরা, এ, এরা, ও, ওরা
২. আত্মবাচক: স্বয়ং, নিজে, খোদ, আপনি
৩. সামীপ্যবাচক: এ, এই, এরা, ইহারা, ইনি
৪. দূরত্ববাচক: ঐ, ঐসব ইত্যাদি
৫. সাকুল্যবাচক সব, সকল, সমুদয়, তাবৎ
৬. প্রশ্নবাচক: কে, কি, কী, কোন, কাহার, কার, কিসে
৭. অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক: কোন, কেহ, কেউ, কিছু
৮. ব্যতিহারিক: আপনা আপনি, নিজে নিজে, আপসে, পরস্পর
৯. সংযোগজ্ঞাপক: যে, যিনি, যাঁরা, যারা, যাহারা
১০. অন্যাদিবাচক: অন্য, অপর, পর
১৫। বিশেষণ পদ: যে পদ বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে তাকে বিশেষণ পদ বলে। যেমন: চলন্ত গাড়ি: বিশেষ্যের বিশেষণ।
করূণাময় তুমি: সর্বনামের বিশেষণ।
দ্রুত চল: ক্রিয়া বিশেষণ।
১৬। বিশেষণ দুই ভাগে বিভক্ত। যেমন:
• নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ কোনো বিশেষ্য বা সর্বনাম পদকে বিশেষিত করে তাকে নাম বিশেষণ বলে।
• ভাববিশেষণ: যে পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম ভিন্ন অন্য পদকে বিশেষিত করে তাই ভাব বিশেষণ।
১৭। নাম বিশেষণ :
• বিশেষ্যের বিশেষণ: সুস্থ সবল দেহকে কে না ভালোবাসে?
• সর্বনামের বিশেষণ: সে রূপবান ও গুণবান।
১৮। নাম বিশেষণকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
ক) রূপবাচক: নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, কালো মেঘ
খ) গুণবাচক: চৌকস লোক, দক্ষ কারিগর, ঠান্ডা হাওয়া
গ) অবস্থাবাচক: তাজা মাছ, রোগা ছেলে, খোঁড়া পা
ঘ) সংখ্যাবাচক: হাজার লোক, দশ দশা, শ টাকা
ঙ) ক্রমবাচক: দশম শ্রেণি, সত্তর পৃষ্ঠা, প্রথমা কন্যা
চ) পরিমাণবাচক: বিঘাটেক জমি, পাঁচ শতাংশ ভূমি, হাজার টনী জাহাজ, এক কেজি চাল, দুকিলোমিটার রাস্তা
ছ) অংশবাচক: অর্ধেক সম্পত্তি, ষোল আনা দখল, সিকি পথ
জ) উপাদানবাচক: বেলে মাটি, মেটে কলসি, পাথুরে মূর্তি
ঝ) প্রশ্নবাচক: কতদূর পথ? কেমন অবস্থা?
ঞ) নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক: এই লোক, সেই ছেলে, ছাব্বিশে মার্চ
১৯। ভাব বিশেষণ: যে পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম ভিন্ন অন্য পদকে বিশেষিত করে তাই ভাব বিশেষণ। ভাব বিশেষণ চার প্রকার। যেমন:
১. ক্রিয়া বিশেষণ: যে পদ ক্রিয়া সংঘটনের ভাব, কাল বা রূপ নির্দেশ করে তাকে ক্রিয়া বিশেষণ বলে। যেমন:
– ক্রিয়া সংগঠনের ভাব: ধীরে ধীরে বায়ু বয়।
ক্রিয়া সংগঠনের কাল পরে একবার এসো।
২. বিশেষণীয় বিশেষণ: যে পদ নাম বিশেষণ অথবা ক্রিয়া বিশেষণকে বিশেষিত করে তাকে বিশেষণীয় বিশেষণ বলে। যেমন:
– ক) নাম বিশেষণের বিশেষণ: সামান্য একটু দুধ দাও। এ ব্যাপারে সে অতিশয় -দুঃখিত।
– খ) ক্রিয়া বিশেষণের বিশেষণ: রকেট অতি দ্রুত চলে।
৩. অব্যয়ের বিশেষণ যে ভাব বিশেষণ অব্যয় পদ অথবা অব্যয় পদের অর্থকে বিশেষিত করে তাকে অব্যয়ের বিশেষণ বলে। যেমন: ধিক্ তারে, শত ধিক্ নির্লজ্জ যে জন।
৪. বাক্যের বিশেষণ: কখনো কখনো কোনো বিশেষণ পদ একটি সম্পূর্ণ বাক্যকে বিশেষিত করতে পারে তখন তাকে বাক্যের বিশেষণ বলা হয়। যেমন: দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ আবার নানা সমস্যাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবিকই আজ আমাদের কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন।
২০। বিভিন্নভাবে বিশেষণ গঠন করা যায়। যেমন:
ক) ক্রিয়াজাত: হারানো সম্পত্তি, খাবার পানি, অনাগত দিন
খ) অব্যয়জাত: আচ্ছা মানুষ, উপরি পাওনা, হঠাৎ বড়লোক
গ) সর্বনাম জাত: কবেকার কথা, কোথাকার কে, স্বীয় সম্পত্তি
ঘ) সমাসসিদ্ধ: বেকার, নিয়ম-বিরুদ্ধ, জ্ঞানহারা চৌচালা ঘর
ঙ) বীপ্সামূলক: হাসিহাসি মুখ, কাঁদকাঁদ চেহারা, ডুবুডুবু নৌকা
চ) অনুকার অব্যয়জাত কনকনে শীত, শনশনে হাওয়া, ধিকিধিকি আগুন, টসটসে ফল, তকতকে মেঝে
ছ) কৃদন্ত: কৃতী সন্তান, জানাশোনা লোক, পায়েচলা পথ, হৃত সম্পত্তি, অতীত কাল
জ) তদ্ধিতান্ত: জাতীয় সম্পদ, নৈতিক বল, মেঠো পথ
ঝ) উপসর্গযুক্ত: নিখুঁত কাজ, অপহৃত সম্পদ, নির্জলা মিথ্যে
ঞ) বিদেশি: নাস্তানাবুদ অবস্থা, লাওয়ারিশ মাল, লাখেরাজ সম্পত্তি, দরপত্তনি তালুক
২১। বিশেষণের অতিশায়ন: বিশেষণ পদ যখন দুই বা ততোধিক বিশেষ্য পদের মধ্যে গুণ, অবস্থা, পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে তুলনায় একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বুঝিয়ে থাকে তখন তাকে বিশেষণের অতিশায়ন বলে। যেমন: যমুনা একটি দীর্ঘ নদী, পদ্মা দীর্ঘতর কিন্তু মেঘনা বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। সূর্য, পৃথিবী ও চন্দ্রের মধ্যে তুলনায় সূর্য বৃহত্তম, পৃথিবী চন্দ্রের চেয়ে বৃহত্তর এবং চন্দ্র পৃথিবী অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর।
২১। বিশেষণের অতিশায়ন দুই প্রকার। যেমন: বাংলা শব্দের অতিশায়ন ও তৎসম শব্দের অতিশায়ন।
একই পদের বিশেষ্য ও বিশেষণ রূপে প্রয়োগ (পদ প্রকরণ)
বাংলা ভাষায় একই পদ বিশেষ্য ও বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন:
১. ভালো
- বিশেষণ রূপে- ভালো বাড়ি পাওয়া কঠিন।
- বিশেষ্য রূপে- আপন ভালো সবাই চায়।
২. মন্দ
- বিশেষণ রূপে- মন্দ কথা বলতে নাই।
- বিশেষ্য রূপে- এখানে কী মন্দটা তুমি দেখলে?
৩. পূণ্য
- বিশেষণ রূপে- তোমার এ পূণ্য প্রচেষ্টা সফল হোক।
- বিশেষ্য রূপে- পূণ্যে মতি হোক।
৪. নিশীথ
- বিশেষণ রূপে- নিশীথ রাতে বাজছে বাঁশি।
- বিশেষ্য রূপে- গভীর নিশীথে প্রকৃতি সুপ্ত।
৫. শীত
- বিশেষণ রূপে- শীতকালে কুয়াশা পড়ে।
- বিশেষ্য রূপে- শীতের সকালে চারদিক কুয়াশায় অন্ধকার।
৬. সত্য
- বিশেষণ রূপে- সত্য পথে থেকে সত্য কথা বল।
- বিশেষ্য রূপে- এ এক বিরাট সত্য।
অব্যয় পদের সংজ্ঞা ও পদ প্রকরণ
যার ব্যয় বা পরিবর্তন হয় না অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয় শব্দ তাই অব্যয়। অব্যয় শব্দের সাথে কোনো বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয় না, সেগুলোর একবচন বা বহুবচন হয় না এবং সেগুলোর স্ত্রী ও পুরুষবাচকতা নির্ণয় করা যায় না।
২২। অব্যয় পদ: যে পদ সর্বদা অপরিবর্তনীয় থেকে কখনো বাক্যের শোভা বর্ধন করে, কখনো একাধিক পদের, বাক্যাংশের বা বাক্যের সংযোগ বা বিয়োগ সম্বন্ধ ঘটায় তাকে অব্যয় পদ বলে।
২৩। উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে বাংলা ভাষায় তিন প্রকার অব্যয় শব্দ/পদ রয়েছে। যেমন:
১. বাংলা অব্যয় শব্দ: আর, আবার, ও, হ্যাঁ, না ইত্যাদি।
২. তৎসম অব্যয় শব্দ যদি, যথা, সদা, সহসা, হঠাৎ, অর্থাৎ, দৈবাৎ, বরং, পুনশ্চ, আপাতত, বস্তুর ইত্যাদি। ‘এবং ও ‘সুতরাং’ তৎসম শব্দ হলেও বাংলায় এগুলোর অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। সংস্কৃতে ‘এবং’ শব্দের অর্থ এমন, আর ‘সুতরাং’ অর্থ অত্যন্ত, অবশ্য। কিন্তু-ও (বাংলা), সুতরাং-অতএব (বাংলা)
৩. বিদেশি অব্যয় শব্দ আলবত, বহুত, খুব, শাবাণ, খাসা, মাইরি, মারহাবা ইত্যাদি।
২৪। ব্যবহার অনুসারে অব্যয় প্রধানত চার প্রকার। যেমন:
১. সমুচ্চয়ী অব্যয় (সংযোজক, বিয়োজক, সংকোচক)
২. অনন্বয়ী অব্যয়
৩. অনুসর্গ (বিভক্তিসূচক, বিভক্তিসম)
৪. অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়
বিবিধ উপায়ে গঠিত অব্যয় শব্দ
১. একাধিক অব্যয় শব্দযোগে কদাপি, নতুবা, অতএব, অথবা ইত্যাদি।
২. আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশক একই শব্দের দুইবার প্রয়োগে ছি ছি, ধিক্ ধিক্ বেশ ইত্যাদি।
৩. দুটি ভিন্ন শব্দযোগে মোটকথা, হয়তো, যেহেতু, নইলে
৪. অনুকার শব্দযোগে কুহু কুহু, গুন গুন, ঘেউ ঘেউ, শন শন, ছল ছল, কন কন ইত্যাদি।
সমুচ্চয়ী অব্যয় (পদ প্রকরণ)
যে অব্যয় পদ একটি বাক্যের সঙ্গে অন্য একটি বাক্যের অথবা বাক্যস্থিত একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের সংযোজন, বিয়োজন বা সংকোচন ঘটায় তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বা সম্বন্ধবাচক অব্যয় বলে।
ক) সংযোজক অব্যয়
১. উচ্চপদ ও সামাজিক মর্যাদা সকলেই চায়। এখানে ‘ও’ অব্যয়টি বাক্যস্থিত দুটি পদের সংযোজন করছে।
২. তিনি সৎ, তাই সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। এখানে ‘তাই’ অব্যয়টি দুটি বাক্যের সংযোজন ঘটাচ্ছে। আর, অধিকন্তু, সুতরাং শব্দগুলোও সংযোজক অব্যয়।
খ) বিয়োজক অব্যয়
১. হাসেম কিংবা কাসেম এর জন্য দায়ী। এখানে ‘কিংবা’ অব্যয়টি দুটি পদের (হাসেম এবং কাসেমের) বিয়োগ সম্বন্ধ ঘটাচ্ছে।
২. ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’। এখানে ‘কিংবা’ অব্যয়টি দুটি বাক্যাংশের বিয়োজক। আমরা চেষ্টা করেছি বটে কিন্তু কৃতকার্য হতে পারিনি। এখানে ‘কিন্তু’ অব্যয় দুটি বাক্যের বিয়োজক। বা, অথবা, নতুবা, না হয়, নয়তো শব্দগুলো বিয়োজক অব্যয়।
গ) সংকোচক অব্যয় তিনি বিদ্বান অথচ সৎ ব্যক্তি নন। এখানে ‘অথচ’ অব্যয়টি দুটি বাক্যের মধ্যে ভাবের সংকোচ সাধন করেছে। কিন্তু, বরং শব্দগুলোও সংকোচক অব্যয়।
২৫। অনুগামী সমুচ্চয়ী অব্যয়: যে, যদি, যদিও, যেন প্রভৃতি কয়েকটি শব্দ সংযোজক অব্যয়ের কাজ করে থাকে। তাই তাদের অনুগামী সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে। যেমন:
১. তিনি এত পরিশ্রম করেন যে তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
২. আজ যদি (শর্তবাচক) পারি, একবার সেখানে যাব।
৩. এভাবে চেষ্টা করবে যেন কৃতকার্য হতে পার।
অনন্বয়ী অব্যয় (পদ প্রকরণ)
যে সকল অব্যয় বাক্যের অন্য পদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রেখে স্বাধীনভাবে নানাবিধ ভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয় তাদের অনন্বয়ী অব্যয় বলে। যেমন:
ক) উচ্ছ্বাস প্রকাশে: মরি মরি! কী সুন্দর প্রভাতের রূপ।
খ) স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপনে: হ্যাঁ, আমি যাব। না, আমি যাব না।
গ) সম্মতি প্রকাশে: আমি আজ আলবত যাব। নিশ্চয়ই পারব।
ঘ) অনুমোদনবাচকতায় আপনি যখন বলছেন, বেশ তো আমি যাব।
ঙ) সমর্থনসূচক জবাবে আপনি যা জানেন তা তো ঠিকই বটে।
চ) যন্ত্রণা প্রকাশে: উঃ! পায়ে বড্ড লেগেছে। নাঃ! এক অসহ্য।
ছ) ঘৃণা বা বিরক্তি প্রকাশে ছি ছি! তুমি এত নীচ। কী আপদ! লোকটা যে পিছু ছাড়ে না।
জ) সম্বোধনে: ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
ঝ) সম্ভাবনায়: সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে।
ঞ) বাক্যালংকার অব্যয়: কয়েকটি অব্যয় শব্দ নিরর্থকভাবে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের শোভাবর্ধন করে, এদের বাক্যালংকার অব্যয় বলে।
অনুসর্গ অব্যয় (পদ প্রকরণ)
যে সকল অব্যয় শব্দ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের বিভক্তির ন্যায় বসে কারকবাচকতা প্রকাশ করে তাদের অনুসর্গ অব্যয় বলে। যেমন: ওকে দিয়ে এ কাজ হবে না। (দিয়ে অনুসর্গ অব্যয়)। অনুসর্গ অব্যয় ‘পদান্বয়ী অব্যয়’ নামেও পরিচিত। অনুসর্গ অব্যয় দুই প্রকার। যেমন: বিভক্তিসূচক অনুসর্গ অব্যয় ও বিভক্তিসম অনুসর্গ অব্যয়।
অনুকার অব্যয় (পদ প্রকরণ)
যে সকল অব্যয় অব্যক্ত রব, শব্দ বা ধ্বনির অনুকরণে গঠিত হয় তাদের অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে। যেমন:
- বজ্রের ধ্বনি: কড় কড়
- মেঘের গর্জন: গুড় গুড়
- বৃষ্টির তুমূল শব্দ ঝম ঝম
- সিংহের গর্জন: গর গর
- স্রোতের ধ্বনি: কল কল
- ঘোড়ার ডাক: চিহি চিহি
- বাতাসের গতি: শন শন
- কাকের ডাক: কাকা
- শুষ্ক পাতার শব্দ: মর মর
- কোকিলের ডাক: কুহু কুহু
- নুপূরের আওয়াজ: রুম ঝুম
- চুড়ির শব্দ: টুং টাং
২৫। অনুভূতিমূলক অব্যয়ও অনুকার অব্যয়ের শ্রেণিভূক্ত। যেমন: ঝাঁ ঝাঁ (প্রখরতাবাচক), খাঁ খাঁ (শূন্যতাবাচক), কচ কচ, কট কট, টল মল, ঝল মল, চক চক, ছম ছম, টন টন, খট খট ইত্যাদি।
২৬। অব্যয় বিশেষণ: কতগুলো অব্যয় বাক্যে ব্যবহৃত হলে নামবিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ ও বিশেষণীয় বিশেষণের অর্থবাচকতা প্রকাশ করে থাকে। এদের অব্যয় বিশেষণ বলা হয়। যেমন:
• নামবিশেষণ: অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ
• ভাব বিশেষণ: আবার যেতে হবে
• ক্রিয়াবিশেষণ: অন্যত্র চলে যায়
২৭। কতগুলো যুগ্মশব্দ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল সেগুলো নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয় রূপে পরিচিত। যেমন: যেমন, তথা, যত-তত, যখন-তখন, যেমন- তেমন, যেরূপ-সেরূপ ইত্যাদি। যথা ধর্ম তথা জয়। যত গর্জে তত বর্ষে না।
২৮। ত-প্রত্যয়ান্ত অব্যয় বাংলায় ব্যবহৃত হয়। যেমন ধর্মত বলছি। দুর্ভাগ্যবশত পরীক্ষায় ফেল করেছি। অন্তত তোমার যাওয়া উচিত। জ্ঞানত মিথ্যা বলিনি।
ক্রিয়া পদ প্রকরণ
যে পদের দ্বারা কোনো কার্য সম্পাদন করা বোঝায় তাকে ক্রিয়াপদ বলে।
১. কবির বই পড়ছে।
২. তোমরা আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
‘পড়ছে’ ও ‘দেবে’ পদ দুটো দ্বারা কোনো কার্য সম্পাদন করা বোঝাচ্ছে বলে এরা ক্রিয়াপদ।
২৯। বাক্যের অন্তর্গত যে পদ দ্বারা কোনো পুরুষ কর্তৃক নির্দিষ্ট কালে কোনো কার্যের সংঘটন বোঝায় তাকে ক্রিয়াপদ বলে।
৩০। বিবিধ অর্থে ক্রিয়াপদকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন:
৩১। ভাবপ্রকাশ ক্রিয়া: ভাব প্রকাশের দিক দিয়ে ক্রিয়াপদ ২ প্রকার। যেমন: সমাপিকা ক্রিয়া, অসমাপিকা ক্রিয়া
৩২। অন্যান্যভাবে ক্রিয়াপদ ৬ প্রকার। যেমন: অকর্মক, সকর্মক দ্বিকর্মক, প্রযোজক ক্রিয়া, যৌগিক ক্রিয়া, মিশ্র ক্রিয়া।
৩৩। ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে পুরুষ অনুযায়ী কালসূচক ক্রিয়াবিভক্তি যোগ করে ক্রিয়াপদ গঠন করতে হয়। যেমন: ‘পড়ছে’-পড় ‘ধাতু’+’ছে’ বিভক্তি।
৩৪। ক্রিয়া: যে শব্দ দিয়ে কাজ বুঝায় তাকে ক্রিয়া বলে।
৩৫। অনুক্ত ক্রিয়া: যে বাক্যে ক্রিয়া উহ্য থাকে তাকে অনুক্ত ক্রিয়া বলে।
৩৬। সমাপিকা ক্রিয়া: যে ক্রিয়া বাক্যকে সমাপ্ত করে তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে।
৩৭। অসমাপিকা ক্রিয়া: যে ক্রিয়া বাক্যকে সমাপ্ত করতে পারে না তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে।
৩৮। সকর্মক ক্রিয়া: যে ক্রিয়ার কর্মপদ থাকে তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে।
৩৯। অকর্মক ক্রিয়া: যে বাক্যে কোনো কর্মপদ থাকে না তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে।
৪০। দ্বিকর্মক ক্রিয়া: যে ক্রিয়ার দুটি কর্ম থাকে তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে।
৪১। সমধাতুজ কর্ম: যে বাক্যে ক্রিয়া ও কর্মপদ একই ধাতু থেকে তৈরি তাকে সমধাতুজ/ধাত্বর্থক কর্ম বলে।
৪২। প্রযোজক ক্রিয়া: যে ক্রিয়া প্রযোজনা করে তাকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে।
৪৩। নামধাতু: বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে আ-প্রত্যয়যোগে গঠিত ধাতুকে নামধাতু বলে।
৪৪। যৌগিক ক্রিয়া: সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়া দিয়ে গঠিত বিশেষ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশক ক্রিয়াকে যৌগিক ক্রিয়া বলে।
৪৫। মিশ্রক্রিয়া: বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে কর, হ, দে, পা, যা, কাট, গা, ছাড়, ধর, মার ইত্যাদি ধাতু দিয়ে গঠিত ক্রিয়াকে মিশ্রক্রিয়া বলে।
৪৬। ক্রিয়াপদ বাক্যগঠনের অপরিহার্য অঙ্গ। ক্রিয়াপদ ভিন্ন কোনো মনোভাবই সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না। তবে কখনো কখনো বাক্যে ক্রিয়াপদ উহ্য বা অনুক্ত থাকতে পারে। যেমন:
- ইনি আমার ভাই = ইনি আমার ভাই (হন)।
- আজ প্রচণ্ড গরম = আজ প্রচণ্ড গরম (অনুভূত হচ্ছে)
- তোমার মা কেমন? তোমার মা কেমন (আছেন)?
বাক্যে সাধারণত ‘হু’ ও ‘আছ’ ধাতু গঠিত ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে।
৪৭। সমাপিকা ক্রিয়া: যে ক্রিয়াপদ দ্বারা বাক্যের (মনোভাবের) পরিসমাপ্তি জ্ঞাপিত হয় তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন: ছেলেরা খেলা করছে। এ বছর বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
৪৮। সমাপিকা ক্রিয়া সকর্মক, অকর্মক ও দ্বিকর্মক হতে পারে। ধাতুর সঙ্গে বর্তমান, অতীত বা ভবিষ্যত কালের বিভক্তি যুক্ত হয়ে সমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়। যেমন:
- আনোয়ার বই পড়ে। এখানে ক্রিয়া-সকর্মক আর কাল-বর্তমান।
- মাসুদ সারাদিন খেলেছিল। এখানে ক্রিয়া-অকর্মক আর কাল-অতীত।
- আমি তোমাকে একটি কলম উপহার দেব। এখানে ক্রিয়া-দ্বিকর্মক আর কাল-ভবিষ্যত।
৪৯। অসমাপিকা ক্রিয়া: যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্যের পরিসমাপ্তি ঘটে না, বক্তার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন: প্রভাতে সূর্য উঠলে…। আমরা হাত- মুখ ধুয়ে …।
৫০। সাধারণত ইয়া (পড়িয়া), ইলে (পড়িলে), ইতে (পড়িতে), এ (পড়ে), লে (পড়লে), তে (পড়তে) বিভক্তিযুক্ত ক্রিয়াপদ অসমাপিকা ক্রিয়া।
৫১। ধাতুর সঙ্গে কাল নিরপেক্ষ-ইয়া (য়ে),-ইতে (তে) অথবা ইলে (লে বিভক্তি যুক্ত হয়ে অসমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়। যেমন: ‘দরিদ্র পাইলে ধন হয় গর্বস্ফীত।’ যত্ন করলে রত্ন মেলে। তাকে খুঁজে নিয়ে আসতে চেষ্টা করবে।
৫২। ধাতুর ক্রিয়া ঘটিত বাক্যে একাধিক প্রকার কর্তা (কর্তৃকারক) দেখা যায়।
৫৩। ‘ইলে’>’লে’ বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার
ক) কার্যপরম্পরা বোঝাতে চারটা বাজলে স্কুলের ছুটি হবে।
খ) প্রশ্ন বা বিস্ময় জ্ঞাপনে একবার মরলে কি কেউ ফেরে?
গ) সম্ভাব্যতা অর্থে: এখন বৃষ্টি হলে ফসলের ক্ষতি হবে।
ঘ) সাপেক্ষতা বোঝাতে তিনি গেলে কাজ হবে।
ঙ) দার্শনিক সত্য প্রকাশে জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?
চ) বিধিনির্দেশে: এখানে প্রচারপত্র লাগালে ফৌজদারিতে সোপর্দ হবে।
ছ) সম্ভাবনার বিকল্পে আজ গেলেও যা, কাল গেলেও তা।
জ) পরিণতি বোঝাতে বৃষ্টিতে ভিজলে সর্দি হবে।
৫৪। এ’ বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার
ক) অনন্তরতা বা পর্যায় বোঝাতে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বস।
খ) হেতু অর্থে: ছেলেটি কুসঙ্গে মিশে নষ্ট হয়ে গেল।
গ) ক্রিয়া বিশেষণ অর্থে চেঁচিয়ে কথা বলো না।
ঘ) ক্রিয়ার অবিচ্ছিন্নতা বোঝাতে হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া গাহিয়া গান।
ঙ) ভাববাচক বিশেষ্য গঠনে সেখানে আর গিয়ে কাজ নাই।
চ) অব্যয় পদেও অনুরূপ: ঢাকা গিয়ে বাড়ি যাব।
৫৫। ‘ইতে’>’তে’ বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার
ক) ইচ্ছা প্রকাশে: এখন আমি যেতে চাই।
খ) উদ্দেশ্য বা নিমিত্ত অর্থে মেলা দেখতে ঢাকা যাব। :
গ) সামর্থ্য বোঝাতে খোকা এখন হাঁটতে পারে।
ঘ) বিধি বোঝাতে: বাল্যকালে বিদ্যাভ্যাস করতে হয়।
ঙ) দেখা বা জানা অর্থে রমলা গাইতে জানে।
চ) আবশ্যকতা বোঝাতে এখন ট্রেন ধরতে হবে।
ছ) সূচনা বোঝাতে: রানি এখন ইংরেজি পড়তে শিখেছে।
জ) বিশেষণবাচকতায় লোকটাকে দৌড়াতে দেখলাম।
ঝ) ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য গঠনে তোমাকে তো এ গ্রামে থাকতে দেখিনি।
ঞ) অনুসর্গরূপে: কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল।
ট) বিশেষ্যেও সঙ্গে অন্বয় সাধনে দেখিতে বাসনা মাগো তোমার চরণ।
ঠ) বিশেষণের সঙ্গে অন্বয় সাধনে পদ্মফুল দেখতে সুন্দর।
৫৬। ‘ইতে’>’তে’ বিভক্তিযুক্ত ক্রিয়ার দ্বিত্ব প্রয়োগ
ক) নিরন্তরতা প্রকাশে: কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা।
খ) সমকাল বোঝাতে সেঁউতিতে পদ দেবী রাখিতে রাখিতে
[টীকা: রীতিসিদ্ধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাপিকা ক্রিয়া অনুপস্থিত থেকে অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহারে বাক্য গঠিত হতে পারে। যেমন: গরু মেরে জুতা দান। আঙুল ফুলে কলাগাছ।]
৫৭। সকর্মক ক্রিয়া: যে ক্রিয়ার কর্মপদ আছে তাই সকর্মক ক্রিয়া। ক্রিয়ার সাথে কী বা কাকে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তাই ক্রিয়ার কর্মপদ। কর্মপদযুক্ত ক্রিয়াই সকর্মক ক্রিয়া। যেমন: বাবা আমাকে একটি কলম কিনে দিয়েছেন।
প্রশ্ন: কী দিয়েছেন?
উত্তর: কলম (কর্মপদ) item
প্রশ্ন: কাকে দিয়েছেন?
উত্তর : আমাকে (কর্মপদ) item ‘দিয়েছেন’ ক্রিয়াপদটির কর্ম পদ থাকায় এটি সকর্মক ক্রিয়া।
৫৮। অকর্মক ক্রিয়া: যে ক্রিয়ার কর্ম নাই, তা অকর্মক ক্রিয়া। যেমন: মেয়েটি হাসে। ‘কী হাসে’ বা ‘কাকে হাসে’ প্রশ্ন করলে কোন উত্তর হয় না। কাজেই ‘হাসে’ ক্রিয়াটি অকর্মক ক্রিয়া।
৫৯। দ্বিকর্মক ক্রিয়া: যে ক্রিয়ার দুটি কর্মপদ থাকে তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে। দ্বিকর্মক ক্রিয়ার বস্তুবাচক কর্মপদটিকে মুখ্য বা প্রধান কর্ম এবং ব্যক্তিবাচক কর্মপদটিকে গৌণকর্ম বলে। বাবা আমাকে একটি কলম কিনে দিয়েছেন বাক্যে ‘কলম’ (বস্তু) মুখ্যকর্ম এবং ‘আমাকে’ (ব্যক্তি) গৌণকর্ম।
৬০। সমধাতুজ কর্ম: বাক্যের ক্রিয়া ও কর্মপদ একই ধাতু থেকে গঠিত হলে ঐ কর্মপদকে সমধাতুজ কর্ম বা ধাত্বর্থক কর্মপদ বলে। যেমন: আর কত খেলা খেলবে। মূল ‘খেলা’ ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ ‘খেলবে’ এবং কর্মপদ ‘খেলা’ উভয়ই গঠিত হয়েছে। তাই ‘খেলা’ পদটি সমধাতুজ বা ধাতুর্থক কর্ম।
৬১। সমধাতুজ কর্মপদ অকর্মক ক্রিয়াকে সকর্মক করে। যেমন:
- এমন সুখের মরণ কে মরতে পারে?
- বেশ এক ঘুম ঘুমিয়েছি।
- আর মায়াকান্না কেঁদো না গো বাপু।
৬২। প্রয়োগ বৈশিষ্ট্য সকর্মক ক্রিয়া ও অকর্মক হতে পারে। যেমন:
অকর্মক
• আমি চোখে দেখি না।
• ছেলেটা কানে শোনে না।
• আমি রাতে খাব না।
• অন্ধকারে আমার খুব ভয় করে।
সকর্মক
• আকাশে চাঁদ দেখি না।
• ছেলেটা কথা শোনে।
• আমি রাতে ভাত খাব না।
• বাবাকে আমার খুব ভয় করে।
৬৩। প্রযোজক ক্রিয়া: যে ক্রিয়া একজনের প্রযোজনা বা চালনায় অন্য কর্তৃক অনুষ্ঠিত হয় সেই ক্রিয়াকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে। সংস্কৃত ব্যাকরণে একে ণিজন্ত ক্রিয়া বলা হয়।
৬৪। প্রযোজক কর্তা: যে ক্রিয়া প্রযোজনা করে তাকে প্রযোজক কর্তা বলে।
৬৫। প্রযোজ্য কর্তা: যাকে দিয়ে ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হয় তাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে।
- প্রযোজক কর্তা প্রযোজ্য কর্তা প্রযোজক ক্রিয়া
- মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।
- (তুমি) খোকাকে কাঁদিও না।
- সাপুড়ে সাপ খেলায়।
৬৬। বিশেষ দ্রষ্টব্য বা জ্ঞাতব্য: প্রযোজক ক্রিয়া রূপে ব্যবহৃত হলে অকর্মক প্রযোজক ক্রিয়া সকর্মক হয়।
৬৭। প্রযোজক ক্রিয়ার গঠন: প্রযোজক ক্রিয়ার ধাতু-মূল ক্রিয়ার ধাতু+আ। যেমন: মূল ধাতু হাস্+আ-হাসা (প্রযোজক ক্রিয়ার ধাতু)। হাসা+চ্ছেন বিভক্তি-হাসাচ্ছেন (প্রযোজক ক্রিয়া)।
৬৮। বিশেষ্য, বিশেষণ এবং ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে ‘আ’ প্রত্যয়যোগে যেসব ধাতু গঠিত হয় তাদের নামধাতু বলা হয়। নামধাতুর সঙ্গে পুরুষ বা কালসূচক ক্রিয়াবিভক্তি যোগে নামধাতুর ক্রিয়াপদ গঠিত হয়। যেমন:
ক) বেত (বিশেষ্য) আ (প্রত্যয়) বেতা: শিক্ষক ছাত্রটিকে বেতাচ্ছেন
খ) বাঁকা (বিশেষণ)+আ (প্রত্যয়) বাঁকা: কঞ্চিটি বাঁকিয়ে ধর
গ) ধ্বন্যাত্মক অব্যয়: কন কন-দাঁতটি ব্যথায় কনকনাচ্ছে। ফোঁস-অজাকারটি ফোঁসাচ্ছে।
আরো পড়ুন:
- বাংলা শব্দ ভান্ডার (সমার্থক শব্দ)
- বাংলা ভাষার ধ্বনি ও বর্ণ প্রকরণ
- বাংলা ভাষার (ব্যাকরণ) উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
- বাংলা সাহিত্যের পংক্তি ও উদ্ধৃতি
৬৯। আ-প্রত্যয় যুক্ত না হয়েও কয়েকটি নামধাতু বাংলা ভাষায় মৌলিক ধাতুর মতো ব্যবহৃত হয়। যেমন:
• ফল: বাগানে বেশ কিছু লিচু ফলেছে।
• টক: তরকারি বাসি হলে টকে।
• ছাপা: আমার বন্ধু বইটা ছেপেছে।
৭০। একটি সমাপিকা ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া যদি একত্রে একটি বিশেষ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। যেমন:
ক) তাগিদ দেওয়া অর্থে ঘটনাটা শুনে রাখ।
খ) নিরন্তরতা অর্থে তিনি বলতে লাগলেন।
গ) কার্যসমাপ্তি অর্থে ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়ল।
ঘ) আকস্মিকতা অর্থে: সাইরেন বেজে উঠল।
ঙ) অভ্যস্ততা অর্থে: শিক্ষায় মন সংস্কারমুক্ত হয়ে থাকে।
চ) অনুমোদন অর্থে: এখন যেতে পার।
৭১। অসমাপিকা ক্রিয়ার পরে যা, পড়, দেখ, লাগ, ফেল্, আস্, উঠ, দে, লহ, থাক প্রভৃতি ধাতু থেকে সমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়ে উভয়ে মিলিতভাবে যৌগিক ক্রিয়া তৈরি করে। এসব যৌগিক ক্রিয়া বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। যেমন:
যা- ধাতু
ক) সমাপ্তি অর্থে: বৃষ্টি থেমে গেল।
খ) অবিরাম অর্থে: গায়ক গেয়ে যাচ্ছেন।
গ) ক্রমশ অর্থে: চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
ঘ) সম্ভাবনা অর্থে: এখন যাওয়া যেতে পারে।
পড়-ধাতু
ক) সমাপ্তি অর্থে: এখন শুয়ে পড়।
খ) ব্যাপ্তি অর্থে: কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে।
গ) আকস্মিকতা অর্থে এখনই তুফান এসে পড়বে।
ঘ) ক্রমশ অর্থে: কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়েছি।
দেখ-ধাতু
ক) মনোযোগ আকর্ষণে: এদিকে চেয়ে দেখ।
খ) পরীক্ষা অর্থে: লবণটা চেখে দেখ।
গ) ফল সম্ভাবনায় সাহেবকে বলে দেখ।
আস্-ধাতু
ক) সম্ভাবনায়: আজ বিকেলে বৃষ্টি আসতে পারে।
খ) অভ্যস্ততায়: আমরা এ কাজই করে আসছি।
গ) আসন্ন সমাপ্তি অর্থে: ছুটি ফুরিয়ে আসছে।
দি- ধাতু
ক) অনুমতি অর্থে: আমাকে যেতে দাও।
খ) পূর্ণতা অর্থে: কাজটা শেষ করে দিলাম।
গ) সাহায্য প্রার্থনায়: আমাকে অঙ্কটা বুঝিয়ে দাও।
নি- ধাতু
ক) নির্দেশ জ্ঞাপনে এবার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নাও।
খ) পরীক্ষা অর্থে: কষ্টি পাথরে সোনাটা কষে নাও।
ফেল্- ধাতু
ক) সম্পূর্ণতা অর্থে: সন্দেশগুলো খেয়ে ফেল।
খ) আকস্মিকতা অর্থে: ছেলেরা হেসে ফেলল।
উঠ-ধাতু
ক) ক্রমান্বয়তা বোঝাতে: ঋণের বোঝা ভারী হয়ে উঠছে।
খ) অভ্যাস অর্থে: শুধু শুধু তিনি রেগে ওঠেন।
গ) আকস্মিকতা অর্থে: সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল।
ঘ) সম্ভাবনা অর্থে: আমার আর থাকা হয়ে উঠল না।
ঙ) সামর্থ্য অর্থে: এসব কথা আমার সহ্য হয়ে ওঠে না।
লাগ-ধাতু
ক) অবিরাম অর্থে: খোকা কাঁদতে লাগল।
খ) সূচনা নির্দেশে: এখন কাজে লাগ তো দেখি।
থাক্-ধাতু
ক) নিরন্তরতা অর্থে এবার ভাবতে থাক।
খ) সম্ভবনায়: তিনি হয়তো বলে থাকবেন।
গ) সন্দেহ প্রকাশে সে-ই কাজটা করে থাকবে।
ঘ) নির্দেশে: আর সরকার নাই, এবার বসে থাক।
৭২। বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে কর্, হ, দে, পা, যা, কাট্, গা, ছাড়, ধর, মার্, প্রভৃতি ধাতুযোগে গঠিত ক্রিয়াপদ বিশেষ বিশেষ অর্থে মিশ্র ক্রিয়া গঠন করে। যেমন :
ক) বিশেষ্যের উত্তর (পরে): আমরা তাজমহল দর্শন করলাম।
খ) বিশেষণের উত্তর (পরে): তোমাকে দেখে বিশেষ প্রীত হলাম।
গ) ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের উত্তর (পরে): মাথা ঝিম ঝিম্ করছে। ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে।
৭৩। ক্রিয়ার যে অবস্থার দ্বারা তা ঘটার ধরন বা রীতি প্রকাশ পায় তাকে ক্রিয়ার ভাব বলে।
১. সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
২. এখন বাড়ি যাও।
৩. সে পড়লে পাশ করত।
৪. তোমার কল্যাণ হোক।
৭৪। ক্রিয়ার ভাব চার প্রকার। যেমন:
১. নির্দেশক ভাব / Indicative Mood
২. অনুজ্ঞা ভাব / Imperative Mood
৩. সাপেক্ষ ভাব / Subjunctive Mood
৪. আকাঙ্ক্ষা প্রকাশক ভাব / Optative Mood
৭৫। সাধারণ ঘটনা নির্দেশ করলে বা কিছু জিজ্ঞাসা করলে ক্রিয়াপদের নির্দেশক ভাব হয়। যেমন:
ক) সাধারণ নির্দেশক: আমরা বই পড়ি। তারা বাড়ি যাবে।
খ) প্রশ্ন জিজ্ঞাসায়: আপনি কি আসবেন? সে কি গিয়েছিল?
৭৬। আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, অনুরোধ, আশীর্বাদ ইত্যাদি সূচিত হলে ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞা ভাব হয়। যেমন:
ক) আদেশাত্মক
বর্তমান কালে-চুপ কর।
ভবিষ্যত কালে- তুমি কাল যেও।
খ) নিষেধাত্মক
বর্তমান কালে-অন্যায় কাজ করো না।
ভবিষ্যত কালে-মিথ্যা বলবে না।
গ) অনুরোধসূচক
বর্তমান কালে-ছাতাটা দিন তো ভাই।
ভবিষ্যত কালে-আপনারা আসবেন।
ঘ) উপদেশাত্মক
বর্তমান কালে-মন দিয়ে পড়।
ভবিষ্যত কালে-স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি রেখো।
৭৭। একটি ক্রিয়ার সংঘটন অন্য একটি ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করলে, নির্ভরশীল ক্রিয়াকে সাপেক্ষ ভাব ক্রিয়া বলা হয়। যেমন:
ক) সম্ভাবনায়: তিনি ফিরে এলে সবকিছুর মীমাংসা হবে। যদি সে পড়ত তবে পাশ করত।
খ) উদ্দেশ্য বোঝাতে ভালো করে পড়লে সফল হবে।
গ) ইচ্ছা বা কামনায় আজ বাবা বেঁচে থাকলে আমার এত কষ্ট হতো না।
৭৮। যে ক্রিয়াপদে বক্তা সোজাসুঝি কোনো ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে তাকে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশক ভাবের ক্রিয়া বলা হয়। যেমন: সে যাক। যা হয় হোক। সে একটু হাসুক। বৃষ্টি আসে আসুক। তার মঙ্গল হোক।
বহুনির্বাচনী প্রশ্ন: পদ প্রকরণ (নিজে কর)
১. নিচের কোনটি গুণবাচক বিশেষ্য?
(ক) সাহসী
(খ) মধুরতা
(গ) সমিতি
(ঘ) দর্শন
২.’ সুন্দর মানুষকে নিজের দিকে টানে বাক্যটিতে’ সুন্দর’ কোন পদ?
(ক) বিশেষ্য
(খ) বিশেষণ
(গ) অব্যয়
(ঘ) ক্রিয়া
৩. ‘নিশীথ রাতে বাজছে বাঁশি’ বাক্যটিতে ‘নিশীথ’ কোন পদ?
(ক) ক্রিয়া বিশেষণ
(খ) ভাববাচক বিশেষ্য
(গ) বিশেষ্যের বিশেষণ
(ঘ) নামবাচক বিশেষ্য
৪. পদ মোট কয় প্রকার?
(ক) চার
(খ) পাঁচ
(গ) ছয়
(ঘ) তিন
৫. নিচের কোনটি উপদেশাত্মক বাক্য?
(ক) তুমি কাল যেও
(খ) অন্যায় কাজ করো না
(গ) মন দিয়ে পড়
(ঘ) ছাতাটা দিন তো ভাই
৬. কোনো বাক্যে যে ক্রিয়াপদ অসমাপ্ত থাকে তাকে কী বলে?
(ক) সমাপিকা ক্রিয়া
(খ) অর্ধ-সমাপিকা ক্রিয়া
(গ) অসমাপিকা ক্রিয়া
(ঘ) অর্ধ-অসমাপিকা ক্রিয়া
৭.’ মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন’ এখানে’ মা’ কোন পদ?
(ক) প্রযোজ্য কর্তা
(খ) প্রযোজক কর্তা
(গ) প্রযোজক ক্রিয়া
(ঘ) দ্বিকর্মক ক্রিয়া
৮. বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সর্বনামকে কয় ভাগে ভাগ করা যায়?
(ক) নয়
(খ) সাত
(গ) তিন
(ঘ) দশ
৯.’ কিছু’ কোন ধরনের সর্বনাম পদ?
(ক) অন্যাদিবাচক
(খ) অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক
(গ) ব্যতিহারিক
(ঘ) সামীপ্যবাচক
১০. বিশেষণের অতিশায়ন কয় প্রকার?
(ক) দুই
(খ) তিন
(গ) চার
(ঘ) পাঁচ
বাংলা ব্যাকরণ পদ প্রকরণ, পদ কত প্রকার কি কি | বাংলা ভাষার পদ প্রকরণ লেকচার শীট ডাউনলোড করুন।