দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে? একই শব্দ বা শব্দাংশ যখন পরপর দুইবার ব্যবহৃত হয়ে একটি অর্থবোধক শব্দ তৈরি করে, তখন তাকে দ্বিরুক্ত শব্দ বলে। বাংলা ভাষায় দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহার করে বক্তব্যে গভীরতা, জোর, স্পষ্টতা বা শব্দের ছন্দ আনা হয়। কখনও এটি আবেগ, তীব্রতা বা সময়ের ধীর পরিবর্তন বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়।
দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে? বিস্তারিত আলোচনা
১। দ্বি মানে দুই আর উক্ত মানে বলা হয়েছে এমন। তাই দ্বিরুক্ত মানে ২ বার বলা হয়েছে এমন দ্বিরুক্ত শব্দ সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে।
২। দ্বিরুক্ত শব্দ ৩ প্রকারঃ শব্দের দ্বিরুক্তি, পদের দ্বিরুক্তি, অনুকার দ্বিরুক্তি।
৩। বাংলা ভাষায় কোনো কোনো শব্দ, পদ বা অনুকার শব্দ একবার ব্যবহার করলে যে অর্থ প্রকাশ করে, সেগুলো দুইবার ব্যবহার করলে অন্য কোনো সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে।
৪। শব্দের পরপর দুইবার প্রয়োগেই দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত হয়। যেমন: আমার জ্বর জ্বর লাগছে। অর্থাৎ ঠিক জ্বর নয়, জ্বরের ভাব অর্থে এই প্রয়োগ।
৫। দ্বিরুক্ত শব্দ নানা রকম হতে পারে। যেমন:
- শব্দের দ্বিরুক্তি: শব্দে যে দ্বিরুক্ত ব্যবহার করা হয় তাকে শব্দের দিরুক্তি বলে। যেমন: ভালো ভালো ফল, বড় বড় বই।
- পদের দ্বিরুক্তি: পদে যে দ্বিরুক্ত ব্যবহার করা হয় তাকে পদের দিরুক্তি বলে। যেমন: ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলাম, মনে মনে আমিও এ কথা ভাবছি।
- ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি: কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে।
৬। পদের দ্বিরুক্তির কিছু নিয়মঃ
- দুটি পদে একই বিভক্তি প্রয়োগ করা হয়, শব্দ দুটি ও বিভক্তি অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: ঘরে ঘরে লেখাপড়া হলো। দেশে দেশে ধন্য ধন্য করতে লাগল। মনে মনে আমিও এ কথাই ভেবেছি। (দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে)
- দ্বিতীয় পদের আংশিক ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটে কিন্তু পদবিভক্তি অবিকৃত থাকে। যেমন: চোর হাতে নাতে ধরা পড়েছে। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
৭। বিভিন্নভাবে পদের দ্বিরুক্তি হতে পারে। যেমন:
- বিশেষ্য শব্দযুগলের বিশেষণরূপে ব্যবহারঃ
- আধিক্য বোঝাতে: রাশি রাশি ধান, ধামা ধামা ধান। ভালো ভালো আম।
- সামান্য বোঝাতে: আমি আজ জ্বর জ্বর বোধ করছি। দেখেছ তার কবি কবি ভাব। উড়ু উড়ু ভাব।
- পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে: তুমি দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ। তুমি বাড়ি বাড়ি হেঁটে চাঁদা তুলেছ।
- ক্রিয়া বিশেষণ: ধীরে ধীরে যায়, ফিরে ফিরে চায়।
- অনুরূপ কিছু বোঝাতেঃ তার সঙ্গী সাথী কেউ নেই।
- আগ্রহ বোঝাতে: ও দাদা দাদা বলে কাঁদছে।
৮। বিশেষণ শব্দযুগলের বিশেষণ রূপে ব্যবহার
- আধিক্য বোঝাতেঃ ছোট ছোট ডাল কেটে ফেল।
- তীব্রতা বা সঠিকতা বোঝাতেঃ গরম গরম জিলাপি, নরম নরম হাত।
- সামান্যতা বোঝাতেঃ কালো কালো চেহারা।
৯। সর্বনাম শব্দ
- বহুবচন বা আধিক্য বোঝাতে সে সে লোক গেল কোথায়? কে কে এলো? কেউ কেউ বলে।
১০। ক্রিয়াবাচক শব্দ
- বিশেষণ রূপে: এদিকে রুগির তো যায় যায় অবস্থা। তোমার নেই নেই ভাব গেল না।
- স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতেঃ দেখতে দেখতে আকাশ কালো হয়ে এলো।
- ক্রিয়া বিশেষণ: দেখে দেখে যেও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কীভাবে?
- পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে: ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছি।
১১। অব্যয়ের দ্বিরুক্তি
- ভাবের গভীরতা বোঝাতেঃ তার দুঃখ দেখে সবাই হায় হায় করতে লাগল। ছি ছি, তুমি কী করেছ?
- পৌনঃপুনিকতা বোঝাতেঃ বার বার সে কামান গর্জে উঠল।
- অনুভূতি বা ভাব বোঝাতে: ভয়ে গা ছম ছম করছে। ফোঁড়াটা টন টন করছে।
- বিশেষণ বোঝাতে: পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
- ধ্বনিব্যঞ্জনা: ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর।
১২। পদাত্মক দ্বিরুক্তি
- বিভক্তিযুক্ত পদের দুইবার ব্যবহারকে পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলা হয়। এগুলো দুই রকমে গঠিত হয়।
- একই পদের অবিকৃত অবস্থায় দুইবার ব্যবহার। যেমন: ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। হাটে হাটে বিকিয়ে তোর ভরা আপন।
- যুগ্মরীতিতে গঠিত দ্বিরক্ত পদের ব্যবহার। যেমন: হাতেনাতে, আকাশে-বাতাসে, কাপড়-চোপড়, দলেবলে
১৩। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
- কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে।
- ধ্বন্যাত্মক শব্দের দুইবার প্রয়োগের নাম ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি।
- ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুত্ব, আধিক্য ইত্যাদি বোঝায়।
১৪। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরক্তি শব্দ কয়েকটি উপায়ে গঠিত হয়। যেমন:
- মানুষের ধ্বনির অনুকারঃ ভেউ ভেউ-মানুষের উচ্চস্বরে কান্নার ধ্বনি ট্যা ট্যা হি হি টপাটপ পটাপট খলখল
- জীবজন্তুর ধ্বনির অনুকারঃ ঘেউ ঘেউ (কুকুরের ধ্বনি), মিউ মিউ (বিড়ালের ডাক), কুহু কুহু (কোকিলের ডাক) কা কা (কাকের ডাক) কিচির মিচির (দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে)
- বস্তুর ধ্বনির অনুকারঃ ঘচাঘচ (ধান কাটার শব্দ), মড়মড় (গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ), ঝমঝম (বৃষ্টি পড়ার শব্দ) হু হু (বাতাস প্রবাহের শব্দ)
- অনুভূতিজাত কাল্পনিক ধ্বনির অনুকার: ঝিকিমিকি (উজ্জ্বল্য)। ঠা ঠা (রোদের তীব্রতা), কুট কুট (শরীরে কামড় লাগার মতো অনুভূতি) মিনমিন, পিটপিট, ঝি ঝি
১৫। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি গঠন
- একই (ধ্বন্যাত্মক) শব্দের অবিকৃত প্রয়োগ: ধবধব, ঝনঝন, পটপট্
- প্রথম শব্দটির শেষে আ যোগ করে: গপাগপ, টপাটপু, পটাপট
- দ্বিতীয় শব্দটির শেষে ই যোগ করেঃ ধরাধরি, ঝমঝমি, ঝনঝনি
- যুগ্মরীতিতে গঠিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ: কিচিরমিচির (পাখি বা বানরের শব্দ), টাপুর টুপুর (বৃষ্টি পতনের শব্দ), হাপুসহুপুস (গোগ্রাসে কিছু খাওয়ার শব্দ)
- আনি-প্রত্যয় যোগেও বিশেষ্য দ্বিরুক্তি গঠিত হয়: পাখিটার ছটফটানি দেখলে কষ্ট হয়। তোমার বকবকানি আর ভালো লাগে না।
১৬। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের ব্যবহার (বিভিন্ন পদরূপে)
- বিশেষ্য: বৃষ্টির ঝমঝমানি আমাদের অস্থির করে তোলে।
- বিশেষণ: নামিল নভে বাদল ছলছল বেদনায়।
- ক্রিয়া: কলকলিয়ে উঠল সেথায় নারীর প্রতিবাদ।
- ক্রিয়া বিশেষণ: চিকচিক করে বালি কোথা নাহি কাদা।
১৭। বিশিষ্টার্থক বাগধারায় দিরুক্ত শব্দ:
- লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান। (আধিক্য)
- থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে। (কালের বিস্তার)
- ছেলেটিকে চোখের চোখে রেখো। (সতর্কতা)
আরো পড়ুন:
বাক্য কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি?
গুরুত্বপূর্ণ বাংলা সমার্থক শব্দ ভান্ডার
প্রমিত বাংলা বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম
সমাস কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি?
বহুনির্বাচনী প্রশ্ন: দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে (নিজে কর)
১) দেখতে দেখতে আকাশ কালো হয়ে এলো-এই দ্বিরুক্ত শব্দটি কী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?
ক. বিশেষণ রূপে
খ. স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতে
গ. ক্রিয়া বিশেষণ
ঘ. পৌনঃ পুনিকতা
২) পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে অব্যয়ের দ্বিরুক্তি কোনটি?
ক. ভয়ে গা ছম ছম করছে
খ. ফোঁড়াটা টন টন করছে
গ. বারবার সে কামান গর্জে উঠল
ঘ. বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
৩) ভিন্নার্থক শব্দযোগে দ্বিরুক্ত শব্দ কোনটি?
ক. ডাল-ভাত
খ. চালচলন
গ. ছোট-বড়
ঘ. চুপচাপ
৪) ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো-এই দ্বিরুক্ত শব্দে কী প্রকাশ পেয়েছে?
ক. ভাবের প্রগাঢ়তা
খ. সতর্কতা
গ. কালের বিস্তার
ঘ. আধিক্য
দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে?
৫) বস্তুর ধ্বনির অনুকার কোনটি?
ক. ভেউ ভেউ
খ. ঘেউ ঘেউ
গ. ঘচাঘচ
ঘ. ঝিকিমিকি
৬) কোন দ্বিরুক্ত শব্দে আধিক্য প্রকাশ পায়?
ক. গরম গরম জিলাপি
খ. উড়ু উড়ু ভাব
গ. ছোট ছোট ডাল কেটে ফেল
ঘ. নরম নরম হাত
৭) বিশিষ্টার্থক বাগধারায় কালের বিস্তার প্রকাশে দ্বিরুক্তি শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে কোনটিতে?
ক) ফুলগুলো তুই আনরে বাছা বাছা
খ) ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো
গ) থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে
ঘ) লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান
৮) আধিক্য প্রকাশে দ্বিরুক্তি শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে কোনটিতে?
ক) ফুলগুলো তুই আনরে বাছা বাছা
খ) ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখো
গ) থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে
ঘ) লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান
৯) কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে বলে?
ক) পদাত্মক দ্বিরুক্তি
খ) ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি
গ) অব্যয়ের দ্বিরুক্তি
ঘ) সর্বনামের দ্বিরুক্তি
১০) ‘পাখিটার ছটফটানি দেখলে কষ্ট হয়।’ বাক্যটিতে কী যোগে দ্বিরুক্তি শব্দ গঠিত হয়েছে?
ক) অনুসর্গ
খ) উপসর্গ
গ) প্রত্যয়
ঘ) বিভক্তি
দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে? কত প্রকার ও কী কী? লেকচার শীট পিডিএফ ডাউনলোড কর।